★*★আমি এবং সেই মহিলা★*★
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৯ মে, ২০১৬, ১১:১৮:৪৪ রাত
শেষ পর্ব
নির্দিষ্ট দিনে আমি ‘রি-ইউনিয়নে’ অংশ
নিলাম। ছেলেবেলার বন্ধুদের সাথে নিয়ে
একটা দিন এবং রাত চমৎকার কেটে গেলো।
পুরনো স্মৃতিতে রোমন্থনযোগ্য অনেক কিছু
এলেও আশ্চর্যজনকভাবে আমার মা একবারও
আমার মনে এলো না। হাতে অনেক সময় আছে
ফিরবার। তাই শ্রেফ কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে
আমি আমার ছেলেবেলার সেই পুরনো
বসবাসের জায়গায় গেলাম। আমাদের
প্রতিবেশী কয়েকজন তখনো বেঁচে ছিলেন।
ওনারা আমাকে চিনলেন। এদের ভেতর থেকে
একজন বয়স্ক মানুষ এগিয়ে এলেন। আমাকে
চিনতে পেরে তিনি আবার তার ঘরের
ভেতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর, একটা
মুখবন্ধ খাম হাতে নিয়ে আমার সামনে এসে
দাঁড়ালেন। আমাকে চিঠিটি দিয়ে জানালেন
যে, গত রাতে আমার মা- সেই এক চোখা
মহিলা মারা গেছেন। এলাকার সবাই রাতেই
শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছেন। শুনে আমার
ভেতরে কোনো ধরণের অনুভূতি জাগলো না।
আমা রচোখ দিয়ে এক ফোঁটা অশ্রুও বের হলো
না। আমি আমার বর্তমান জীবনের উদ্দেশ্যে
ফিরে যেতে আমার রাস্তায় ফিরে চলি
হেঁটে হেঁটে। আমার হাতে সেই মহিলা যিনি
আমার গর্ভধারিনী ছিলেন, তার লেখা চিঠি!
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত খামের মুখ খুললাম।
অস্পষ্ট হলেও আমার একদার পরিচিত
হস্তাক্ষর মুহুর্তে আমার দৃষ্টিগোচর হলো।
সেই মহিলা আমাকে উদ্দেশ্য করে
লেখেছেন-
‘প্রিয় বাবুটা আমার!
আমি সবসময়েই তোমাকে ভেবেছি। প্রতিটা
মুহুর্ত তোমার মঙ্গলচিন্তায় ঈশ্বরের কাছে
প্রার্থনা করেছি। আমি আবারো দুঃখ
প্রকাশ করছি বাবুটা, সেদিন ওভাবে না
জানিয়ে তোমার বাড়িতে গিয়ে তোমার
মেয়েদেরকে ভয় পাইয়ে দেবার জন্য।
তুমি ‘রি-ইউনিয়নে’ আসবে জেনে আমি খুবই
খুশী হয়েছিলাম। কিন্তু আমি এতটা-ই অসুস্থ
ছিলাম যে, ঐ অনুষ্ঠানে গিয়ে তোমার সাথে
দেখা করার মত শক্তি আমার শরীরে ছিল
না। আমি অত্যন্ত দুঃখিত বাবুটা যে, সেই
ছেলেবেলা থেকে কেবল আমার জন্য
তোমাকে অন্যের কাছে হাসির পাত্র হতে
হয়েছে।
যে কথা কখনো তোমাকে বলিনি প্রিয়
বাবুটা আমার, আজ বলছি শোন। একেবারে
বাবু বয়সে এক দুর্ঘটনায় তোমার একটা চোখ
নষ্ট হয়ে যায়। একজন মা হিসেবে আমি এটা
কল্পনাও করতে পারিনি যে, একটা মাত্র
চোখ নিয়ে তুমি বড় হবে! তাই আমার একটা
চোখ তোমাকে দিয়েছিলাম তখন।
আমি অত্যন্ত গর্ববোধ করেছিলাম যে, আমার
দেয়া চোখ দিয়ে আমার ছেলে আমার জন্য
সমগ্র বিশ্বকে দেখবে! আমি যখন থাকবো না,
তখনও আমি এই পৃথিবীর আলো-বাতাস
দেখবো-অনুভব করবো! আসলে সেটাই কি
হচ্ছে না?
তোমার মেয়ে দুটি খুব সুন্দর! ওদের জন্য
অনেক অনেক আদর রইলো। দুঃখ তোমার
বউকে দেখতে পেলাম না। ওকেও আমার
ভালোবাসা জানিও।
আমার হৃদয়ের সকল ভালোবাসা তোমার জন্য
রেখে গেলাম প্রিয় বাবুটা!
তোমার মা।‘
আমি শেষ লাইনটা পড়ার পর যেখানে
দাড়িয়েছিলাম, রাস্তার মাঝামাঝি স্থাণুর
মত অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। রাস্তায়
অপেক্ষামান গাড়ির বিকট আওয়াজ আমাকে
সরতে বলছিল, আমি কিছু-ই শুনতে পেলাম না।
শেষে এক পথচারী এসে টেনে আমাকে
ফুটপাতে নিয়ে রেখে এলো। আমার মন পুড়ে
যাচ্ছিল.. কোথায় কোথায় যেন চিরে
যাচ্ছিল। হাত থেকে সেই মহিলার লেখা
চিঠিখানা বাতাস উড়িয়ে গেলেও আমি
সেটা ধরার জন্য সামনেও আগাতে
পারছিলাম না। এক অবোধ্য অনুভবে বিলীন
হতে হতে আমার ভেতরে কেবলি এই কথাটি-ই
বার বার বেজে চলছিল, ‘সেই মহিলা আমার
মা ছিলেন!’ একজন এক চোখা মহিলা, যাকে
আমি সারাটা জীবন ঘৃণা-ই করেছি কেবল।
অথচ আমার জন্য শেষ সময় পর্যন্তও কেবল
ভালোবাসা-ই রেখে গেছেন তিনি।
মায়েরা কি এমনই হয়?
... ... ...
সময়ের বুক থেকে আবারো নিজের ধুসর
বর্তমানে ফিরে আসি আমি শিহাব। সেই
বৃদ্ধাশ্রমের নিজের আপাত নিরাপদ কক্ষে।
আয়নায় দেখা সেই অচেনা চোখটিকে আজ
বড্ড চেনা লাগছে। ঐ চোখটি যে আমার
মায়ের! একজন মায়ের চোখ কেমন হয়?
অর্ধেক জীবন পার করেও সেটা আমার বুঝে
আসেনি। যখন বুঝে এলো, তখন সেই বুঝ আমার
কোনো কাজে এলো না।
কথায় বলে, ইতিহাস তার পুনরাবৃত্তি করে
থাকে। আজ এক বৃদ্ধাশ্রমে একজন বাবা তার
বিগত সময়ের ভুল ভাবনার খেসারত দিচ্ছেন
বড্ড তীব্রভাবে। সব কিছু থেকেও আমার
কিছু-ই নেই। অনুভবে রয়েছে, বাস্তবে কেবলি
শূণ্যতা! যে শূণ্যতায় কখনো নিঃশেষ হয়েছে
একজন এক চোখের মহিলা। জীবনভর
ভালোবাসার প্রতিদানে সে কেবলি ঘৃনা-ই
পেয়ে গেছে। তবুও শেষ সময় পর্যন্ত তার
প্রিয় বাবুটার জন্য ভালোবাসা-ই রেখে
গেছে।
বেলা শেষে কোনো প্রিয়জন ফিরে এসে
ডাকবে আমায় কিংবা পাশে এসে নীরবে শুধু
চলে যাওয়া প্রহরকে অনুভব করাবে, এমন
কোনো অনুভবে আজকাল আমি উদ্দীপ্ত হই
না। এ আমার নিজের কর্মফল.. আমি নিজেই
অর্জন করেছি এই নিঃসঙ্গতা!
তাই আমাকে এভাবে-ই থাকতে হবে। আয়নায়
দেখা আমার মায়ের চোখ আমার এই
দুরাবস্থায় কেন জানি ভিজে আসে। তার
প্রিয় বাবুটার এই নিঃসঙ্গতা কেন জানি
তাঁকে পীড়া দেয়। অসহ্য কষ্টকর মুহুর্তগুলিতে
তাই যে চোখটি আমার নয়, সেটি কেঁদে চলে।
আমার নিজের চোখটি অনেক আগেই কেন
জানি নিষ্প্রাণ পাথরে পরিণত হয়েছে। তাই
আমার অনুভূতি-অনুভব সকল ইচ্ছেপালকের
নিউক্লিয়াস ইদানিং সেই একচোখা মহিলার
আমায় ভালোবেসে দান করা চোখকে ঘিরে চলে। আমার মা আমার সাথে থেকে তার চোখ দিয়ে আমাকে দেখছেন, ভালোবাসার দৃষ্টিতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যান আমায়! তার প্রিয় বাবুটাকে!
★ My mom only had one eye- মূল গল্পটির ছায়ায় আমার মত কায়া প্রদর্শণের অক্ষম প্রচেষ্টার ফল এই গল্পটি। তবে এমন মৌলিক লেখা সারা জীবনে অন্তত একটিও যদি লেখা যায়, লেখক জীবন সার্থক বলে মনে করবো।
এটাই আমার প্রথম অন্য ভাষার গল্পকে নিজের মত করে দেশীয় পোষাক পরানো।
বিষয়: সাহিত্য
৯৩৯ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সহমত আপনার সাথে- এমন কোনো ঘটনা কারোর জীবনেই না আসুক।
অনুভূতি রেখে যাবার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
অনুভূতি রেখে গেলেন, শুভেচ্ছা গ্রহন করুন।
সহমত আপনার সাথে-মায়েরা এমনই হয়।
মন্তব্য করতে লগইন করুন